প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ মানুষ। একটু স্বস্তি পেতে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। গাছ না থাকলে তাপমাত্রা বাড়ে। একটি এলাকার আয়তন অনুযায়ী নির্ধারিত সংখ্যক গাছ থাকা প্রয়োজন। রংপুরের তারাগঞ্জে সে অনুযায়ী গাছের সংখ্যা অনেক কম। অথচ বর্তমানে তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে এ উপজেলায় তিস্তা সেচ ক্যানেলের পাঁচ কিলোমিটার অংশের গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় লোকজন ও পরিবেশবাদীরা।
বন বিভাগ বলছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড তিস্তা সেচ ক্যানেলের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য চাপ দেওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গাছগুলো কেটে ফেলছে। পাউবোর কর্মকর্তারাও গাছ কাটার কথা স্বীকার করে বলেছেন, সেচ ক্যানেলের ওই অংশে নতুন করে গাছ লাগানো হবে।
তারাগঞ্জ উপজেলা বন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, কোনো এলাকার মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও তারাগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে তিন ভাগেরও কম বনভূমি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বনায়ন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার কেল্লাবাড়ি থেকে তারাগঞ্জ উপজেলার মিনিটের স-মিল পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে গাছ লাগায় বন বিভাগ। সমিতির মাধ্যমে উপকারভোগী নির্ধারণ করে গাছগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এসব গাছ কেটে ফেলা হলে এ এলাকার বনভূমি ১ শতাংশের নিচে পৌঁছাবে। সবকিছু জানার পরও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উন্নয়নমূলক কাজে গাছগুলো কেটে ফেলার জন্য দরপত্র আহ্বান বন বিভাগ। ইতিমধ্যে চার ভাগের তিন ভাগ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।
উপকারভোগী, ঠিকাদার ও বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সম্প্রতি সেচ ক্যানেলের পাঁচ কিলোমিটারে লাগানো দেড় সহস্রাধিক গাছ বিক্রি করা হয়। ২২ লাখ ৫৫ হাজার ৯৫০ টাকায় দরপত্রের মাধ্যমে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে গাছগুলো বিক্রি করা হয়। গাছ বিক্রির ৫৫ শতাংশ টাকা উপকারভোগী, পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০ শতাংশ, বন বিভাগ ১০ শতাংশ, সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ ৫ শতাংশ এবং বাকি ১০ শতাংশ গাছ বিক্রির টাকা দিয়ে পুনরায় বনায়ন করার নিয়ম।
আজ সরেজমিনে দেখা যায়, রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের তিস্তা সেচ ক্যানেলের তারাগঞ্জ সেতুর কাছে থেকে কেল্লাবাড়ি পর্যন্ত দুই পাশের সব গাছ কাটা হচ্ছে। শ্রমিকের তাপপ্রবাহের মধ্যে গাছগুলো কেটে ট্রলিতে নিয়ে যাচ্ছেন। যেসব গাছ এখনো কাটা হয়নি, সেগুলোর ছায়ায় বসে শ্রমিক ও পথচারীরা বিশ্রাম নিচ্ছেন।
সেখানে কথা হয় পাশের দৌলতপুর গ্রামের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তারাগঞ্জ তিস্তা সেচ ক্যানেল সেতু থেকে তাঁর বাড়ির দূরত্ব ৫০০ মিটার। মিজানুর রহমান আক্ষেপ করেন, ‘সউগ গাছ কাটি সড়কটাক নাড়িয়া (গাছশূন্য) বানাইছে। তাপোতে নিকাশ খড়ে যাওছে (নিশ্বাস নিতে কষ্টে হচ্ছে), মাটিত পাও থোয়া যাওছে না। বাড়ি থাকি এতোকোনা জায়গা হাটি আসনু, তাতে শরীর কুলাওছে না। কয়দিন আগোতও দুপুরে রাস্তাটা দিয়া হাঁটি গেইলে গাওত বাতাস নাগছিল, এ্যালা খালি আগুন ধরা রইদ নাগোছে। গাছগুলো না কাটলে কি হইল হয়।’
আরেক পথচারী অনন্তপুর গ্রামের ডালিম রায় বলেন, ‘বড় গাছগুলা কাটি ছোট গাছগুলো থুইলেও ছায়া পাইনো হয়। চলাচল করতে রইদ থাকি বাঁচনো হয়। কিন্তু এরা সড়কটাক মরুভূমি বানে থুইল। ফির কদ্দিন গাছ নাগাইবে, তাক কদ্দিন বড় হইবে, তারপর ছায়া পামো। তত দিন রইদোত পুড়ি মরি।’
গাছ কাটা শ্রমিক দলের সরদার শরিফুল ইসলাম বলেন, সোমবার পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে দুই কিলোমিটারের ৭২০টি গাছ কাটা হয়েছে। বাকি গাছগুলো দু–এক দিনের মধ্যে কাটা হবে।
কথা হয় ক্যানেলের পাশে তারাগঞ্জ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী লিমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সবুজে ভরা সড়কটিতে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতাম। কলেজ যাওয়ার পথে রোদ-বৃষ্টিতে লুকাতাম। কিন্তু এখন শুধু সূর্যের কড়া তাপ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না।’
তিস্তা সেচ ক্যানেলের গা ঘেঁষে তারাগঞ্জ সরকারি কলেজ, শিশুনিকেতন, তারাগঞ্জ ও/এ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। এ ছাড়া এক কিলোমিটারে মধ্যে আর পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
তারাগঞ্জ ও/এ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ক্যানেলের দুই ধারে গাছ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যেত। হাজারো গাছের ছায়াতলে আশপাশের আটটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০টি গ্রামের শত শত শিক্ষার্থী ক্যানেলের সড়ক ধরে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করত। কিন্তু এখন সব কটি গাছ কেটে ফেলায় তাদের চলাচলে কষ্ট হবে।’
তারাগঞ্জের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আমরাও পারি’র সভাপতি আজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘দেড় লাখ মানুষের জন্য মাত্র ৩ শতাংশ বনায়ন যথেষ্ট নয়। তার ওপর কলকারখানার ধোঁয়া-বাতাস দূষিত করছে। এরই মধ্যে দেশে টানা এক মাসের বেশি প্রচণ্ড তাপমাত্রায় বন বিভাগ গাছগুলো উজাড় করছে। এটা অন্যায়, তারাগঞ্জের মানুষের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। গাছগুলো কাটা বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি।’
জানতে চাইলে গাছ ঠিকাদার তৌহিদুল ইসলাম জুয়েল মুঠোফোনে বলেন, ‘টেন্ডারের মাধ্যমে আড়াই মাস আগে গাছগুলো কিনেছি। তাই কাটছি সমস্যা কী? টেন্ডার দেওয়ার সময় বন বিভাগের চিন্তা করা উচিত ছিল। আপনার বন বিভাগের সঙ্গে কথা বলেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারাগঞ্জ উপজেলা বন কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান রোকন বলেন, তিস্তা সেচ ক্যানেলের তারাগঞ্জের পাঁচ কিলোমিটার অংশের পানি উন্নয়ন বোর্ড উন্নয়নমূলক কাজ করছে। তাঁরা (পাউবো) গাছগুলো কাটার জন্য বারবার চাপ দিচ্ছিল। তাই ঠিকাদাররা গাছ কাটছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডে সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। আবার সেখানে গাছ লাগানো হবে। তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত ১ হাজার ৫৪৪টি গাছ বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
তারাগঞ্জের ইউএনও রুবেল রানা বলেন, ‘তাপপ্রবাহের মধ্যে গাছগুলো না কাটার জন্য বন বিভাগকে বলেছি।’
এ বিষয়ে কথা হলে পরিবেশবাদী ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ক্যানেলে দুই দিকে যে পরিমাণ গাছ কেটেছে, সেটাই পরিবেশের ক্ষতি। বাকি যে গাছগুলো আছে, সেগুলোকে কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায় সেই পরিকল্পনা নেওয়া উচিত।
এই বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সৈয়দপুর কার্যালয়ের উপপ্রকৌশলী রাউফুল হাসান মুঠোফোনে বলেন, তিস্তা সেচ ক্যানেলে উন্নয়নমূলক কাজ চলছে। সে কারণে গাছগুলো কাটা হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী গাছগুলো কাটার সময়ও হয়েছে। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ফের গাছ লাগানো হবে।