অন্ধ বাউল প্রদীপ পালের বাড়িতে গিয়ে খাদ্য সামগ্রী প্রদীপ পালের হাতে তুলে দেন উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ
মন্দিরার তালে তালে জীবন চলে অন্ধ বাউল প্রদীপ চন্দ্র পালের । তিন দিন ব্যাপী জালাল মেলার গানে ভাগ্য বদল হতে চলছে প্রদীপ পালের পরিবারের। নগরে বন্দরে হাটে বাজারে গান গেয়ে সংসার চলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নগর বাউল প্রদীপ চন্দ্র পালের। পিতা তপন চন্দ্র পালের মৃত্যুর পর মা বাসনা রানী পালকে সাথে নিয়ে চলে প্রদীপের জীবন সংসার।
আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে হাতে তুলে নেন এক জোড়া মন্দিরা বা জুড়ি। অন্ধ বাউল প্রদীপ বিভিন্ন হাট বাজারে গিয়ে মন্দিরা বাজিয়ে বাজিয়ে মানুষকে গান শুনান, এই গান শুনে মানুষও মানবিক কারণে তাকে ১০ টাকা, ৫ টাকা, ২০ টাকা কিংবা ৫০ টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেন। ওই টাকা দিয়েই চাল, ডাল, মাছ, তরিতরকারি নিয়ে বাড়ি ফিরেন প্রদীপ।
প্রদীপ পালের বয়সের কথা জানতে চাইলে সোজা কথায় উত্তর দিয়ে বলেন, ১৯৭১ সনের সংগ্রামের তিন বছরের বড় আমি। ১ ভাই এবং ৮ বোনের মধ্যে তিনিই বড়। বাবা না থাকায় বোনদের বিয়ের দায়িত্ব পড়ে প্রদীপ পালের কাধে। জন্মান্ধ প্রদীপ পাল ১ জোড়া মন্দিরা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন ঘর থেকে। এই মন্দিরা বাজিয়ে বাজিয়ে নগরে বন্দরে হাটে বাজারে গান পরিবেশন করেন তিনি। এই উপার্জিত অর্থ দিয়েই ৮ বোনের বিয়ে দেন।
লোক শিল্পী আব্দুল কদ্দুছ বয়াতি ও বিভিন্ন গনমাধ্যম কর্মীদের মাধ্যমে খবর পান তথকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মইনুদ্দিন খন্দকার। তিনি খোজ খবর নিয়ে প্রদীপ পালের ভিটেটে সরকারী খরচে একটি আধা পাকা ঘর করে দেন। কিন্তু ঘরে বিদ্যুৎ , পানি, টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায় অন্য এক বাড়িতে আশ্রয়ে থাকেন তিনি। এভাবেই সুখ দুঃখে খেয়ে না খেয়ে কোনমতে চলছে প্রদীপের সংসার।
চলতি বছরের গত ২৫, ২৬, ২৭ এপ্রিল কেন্দুয়ায় অনুুষ্ঠিত হয় জালাল মেলা। মরনোত্তর একুশে পদক পাপ্ত-২০২৪ আন্তসন্ধানী মরমী বাউল সাধক জালাল উদ্দিন খাঁর ১৩০ তম জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত জালাল মেলায় আমন্ত্রিত হয়ে অন্যান্য বাউলদের সাথে মেলায় গান পরিবেশন করতে আসেন প্রদীপ চন্দ্র পাল।
মেলা উদযাপন কমিটির আহবায়ক কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমদাদুল হক তালুকদারের নজরে পড়েন প্রদীপ পাল। তিনি প্রদীপ পালের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তার পরিবারের যাবতীয় দায়দায়িত্ব উপজেলা প্রশাসনের কাধে তুলে নেন। গত ২ মে বৃহস্পতিবার বিকালে তিনি আলপথ দিয়ে হেটে ছুটে যান নগর বাউল প্রদীপ চন্দ্রের বাড়িতে। কথা বলেন পরিবারের সকল সদস্যদের সাথে।
এসময় তার সাথে ছিলেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো: রাজিব হোসেন, নেত্রকোণা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কেন্দুয়া জোনাল অফিসের ডিজিএম মো: মুজিবুর রহমান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো: আজিজুর রহমান সহ স্থানীয় গনমাধ্যম কর্মীরা। পরিবারের সমস্যার কথা শুনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমদাদুল হক তালুকদার ঘোষনা দিয়ে বলেন, আজ থেকে প্রদীপ চন্দ্র পালের আর কোন দুশ্চিন্তা করতে হবে না। তিনি সচ্ছল জীবন যাপন করবেন। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রদীপ পালের হাতে একটি খাদ্য সামগ্রীর বস্তা তুলে দেন।
এছাড়া তিনি ১০ দিনের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ, নলকূপ স্থাপনের ব্যবস্থা, একটি টয়লেট নির্মাণের পূর্ণ আশ^াস দেন। তাছাড়া দুই কন্যা যে দুটি বিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করে সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছে চিঠি পাঠান যাতে করে প্রদীপ পালের কন্যারা বিনা পয়সায় লেখাপড়া, স্কুল ড্রেস, উপবৃত্তি, শিক্ষা উপকরণ বিনা মূল্যে পেতে পারে। অপর দিকে প্রদীপ পালের স্ত্রী আন্না রানী পালকে উপজেলা সদরে মাসব্যাপী সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে একটি সেলাই মেশিন দিয়ে সাবলম্বী হওয়ার পথ ধরিয়ে দেবেন।
স্থানীয় সংস্কৃতি কর্মীদের দাবির প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রতিদিনের সংসার পরিচালনার জন্য সাহিতপুর বাজারে প্রদীপ পাল কে একটি মুদি দোকান স্থাপন করে দেবেন। যাতে এই দোকানের আয় দিয়ে তার সংসার চলে। এসব ঘোষনার পর প্রদীপ পাল বলেন, অনেক ইউএনও স্যার দেখেছি কিন্তু কেউই এভাবে আমার বাড়িতে খোজ খবর নিতে আসেননি।
পল্লী বিদ্যুতের ডিজিএম মো: মুজিবুর রহমানের সাথে শনিবার বিকালে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সম্ভবত উপজেলা প্রশাসন থেকে আগামীকাল বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য আবেদনটি পাব। আবেদন পাওয়ার পর ৭ দিনের মধ্যেই আমরা প্রদীপ পালের বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে বাড়িতে আলো জ¦ালিয়ে দেবো।
স্থানীয় সংস্কৃতি কর্মীরা বলেন, আমরা অনেক কৃতজ্ঞ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পদক্ষেপের ফলে প্রদীপ পালের পরিবারটি অন্ধকার ছেড়ে আলোর পথ ধরে এগিয়ে যাবে।